চিরস্মরণীয় ও অনুকরণীয় বঙ্গমাতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা


দৈনিক সিরাজগঞ্জ ডেস্ক প্রকাশের সময় : অগাস্ট ৭, ২০২৩, ৯:০৮ অপরাহ্ন /
চিরস্মরণীয় ও অনুকরণীয় বঙ্গমাতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

শেখ হাসিনা একই বইয়ে জানাচ্ছেন, বাসায় গিজগিজ করছে মানুষ। বেগম মুজিব সবাইকে তাদের ঘর থেকে বাইরে যেতে বললেন। ঘরে তখন বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিব আর শেখ হাসিনা। তিনি বললেন, তুমি দশটা মিনিট শুয়ে রেস্ট নাও। শেখ হাসিনার ভাষায়, ‘আমি মাথার কাছে বসা। মা মোড়াটা টেনে নিয়ে আব্বার পায়ের কাছে বসলেন। মা বললেন মনে রেখ, তোমার সামনে লক্ষ মানুষের বাঁশের লাঠি। এই মানুষগুলোর নিরাপত্তা এবং তারা যেন হতাশ হয়ে ফিরে না যায় সেটা দেখা তোমার কাজ। কাজেই তোমার মনে যা আসবে তুমি তাই বলবা, আর কারো পরামর্শ দরকার নাই। তুমি মানুষের জন্য সারাজীবন কাজ করো। কাজেই কি বলতে হবে তুমি জানো। এত কথা, এত পরামর্শ, কারো কথা তোমার শোনার দরকার নাই। এই মানুষগুলোর জন্য তোমার মনে যেটা আসবে, সেটা তুমি বলবা।’

বঙ্গবন্ধু দশ মিনিট বিশ্রাম করলেন, গাড়িতে উঠলেন, শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো হেঁটে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন এবং শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি—এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বললেন, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যার কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। একইসঙ্গে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। গেরিলা যুদ্ধের নির্দেশ দিলেন। অথচ আইনত কেউ তাঁকে আটকাতে পারবে না। সারা পৃথিবী দেখল শেখ মুজিবের সংগ্রাম আইনানুগ অসহযোগ সংগ্রাম, যা কি না মহাত্মা গান্ধী করেছিলেন ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে। পৃথিবীর এরকম কঠিন সময়ে এর চেয়ে রাজনৈতিকভাবে সঠিক ভাষণ আর কেউ কোথাও দিয়েছে বলে মনে হয় না।

এর পেছনে ছিলেন সেই মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব।

১৯৭১ সাল। ২৩ মার্চ। পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে বাংলার ঘরে ঘরে উঠেছে বাংলার পতাকা। এদিকে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা চলছে। বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ও শেখ হাসিনার স্বামী প্রয়াত এম এ ওয়াজেদ মিয়া তাঁর ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ বইয়ে লিখেছেন, ‘ওইদিন বঙ্গবন্ধু দুপুরে কারো সঙ্গে কথা না বলে গম্ভীরভাবে খাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে শাশুড়ি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, এতদিন ধরে যে আলাপ-আলোচনা করলে তার ফলাফল কী হলো, কিছু তো বলছো না। তবে বলে রাখি তুমি যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সমঝোতা করো তবে একদিকে ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী সুবিধা মতো সময়ে তোমাকে হত্যা করবে, অন্যদিকে এ দেশের জনগণও তোমার ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হবে।’ একথা শুনে বঙ্গবন্ধু রাগান্বিত হয়ে শাশুড়িকে বলেন, এখনো আলোচনা চলছে এই মুহূর্তে সবকিছু খুলে বলা সম্ভব না। এই পর্যায়ে শাশুড়ি রেগে গিয়ে নিজের খাবারে পানি ঢেলে দ্রুত ওপরতলায় চলে যান। তিনি না খেয়ে সারাদিন শুয়ে থাকলেন, কারো সঙ্গে কথা বললেন না। এই একটি ঘটনাই কি যথেষ্ট নয় যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বেগম মুজিবের অবদান কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল!
জনগণ তোমার কাছ থেকে সরে যাবে তখন সামরিক জান্তা তোমাকে মেরে ফেলতে পারে। কাজেই আপস করো না। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব নয় তোমার চাই স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুও তাই বলেছেন বারবার, এমনকি নির্বাচনের আগেও, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না আমি বাংলার মানুষের অধিকার চাই। আর যে গেরিলা যুদ্ধ করতে হবে, এটা বঙ্গবন্ধু জানতেন। ঢাকাস্থ আমেরিকান কনস্যুলার কর্তাদের সঙ্গে দেখা করে সেটা তিনি আগেই বলে রেখেছিলেন।

মাত্র ১১ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের। তখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে প্রাথমিকে পড়ছিলেন। তিনি তাঁর মা-বাবাকে হারিয়েছিলেন শৈশবে, মানুষ হয়েছিলেন শাশুড়ির কাছে। তাঁর প্রবল ঝোঁক ছিল পড়াশোনার প্রতি। বাড়িতে শিক্ষক রেখে বাংলা-ইংরেজি-আরবি পড়েছেন। প্রচুর গল্পের বেই পড়তেন, গানও শুনতেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অধিকাংশ সময় জেলেই কাটিয়েছেন। ছেলে-মেয়ে-সংসার একহাতে সবই সামলেছেন বেগম মুজিব। ছেলেমেয়েদের সুরুচি গড়ে উঠেছে মায়ের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা-দীক্ষা থেকেই। খুব অল্প বয়সে জীবন সংগ্রামে নেমে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। সব সামলেছেন, কিন্তু কারোর কাছে মাথানত করেননি। নিজের ব্যক্তিত্ব ঠিক রেখে সীমাহীন প্রজ্ঞা ধৈর্যের সঙ্গে একে একে সব উৎরে নিয়েছেন।

বাংলার নারীর স্নিগ্ধ রূপ আমরা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের মধ্যে দেখতে পাই, কিন্তু রাজনৈতিক প্রশ্নে তিনি ছিলেন অপরিসীম দৃঢ়। তিনি যে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন তা ভেবে সত্যিই আমাদের আশ্চর্য হতে হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁকেও হত্যা করা হয়। নারী জাগরণ কিছুটা হলেও ক্ষণিকের জন্যে থমকে যায় সেদিন। আজ সেই মহীয়সী নারী, মুক্তিদায়িনী, প্রেরণাদায়িনী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জন্মদিন। চিরস্মরণীয় ও অনুকরণীয় বঙ্গমাতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, কৃষক লীগ; চেয়ারম্যান, সমাজসেবামূলক সংস্থা কাঞ্চন মুন্সী ফাউন্ডেশন ও সম্পাদক, ঢাকা টাইমস